শেষ অনুভূতি

প্রকাশ: ১ জুন, ২০১৮ ১২:২০

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


–  নঈম আল ইস্পাহান

অনেকক্ষণ ধরে শিখার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।তার হাত,পা,গলা কাঁপছে।সে কিছু একটা বলতে চাইছে।কিন্তু,পারছেনা।

কাল রাত সাড়ে বারোটার দিকে মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো।শিখা আমাকে তিন মাস পর কল করেছে।ব্রেকাপের পর এইটাই তার প্রথম কল।আমি জানতাম একটা সময় সে যোগাযোগ করবেই।আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শিখা একাই বলতে শুরু করল।শোন,সম্পর্কটা শেষ।তবুও আমি শেষবারের মত তোমার সাথে আরেকবার দেখা করবো।কারণ,তুমিই বলেছিলে আরেকবার দেখা করতে চাও।কাল কোথায় আসব?আমি না ভেবেচিন্তে বললাম,কালকে তো আমার অফিস আছে…অর্ধেক বলেই থেমে গেলাম।সাথে সাথে শিখা বলল,ও আচ্ছা।তুমি তো ব্যস্ত।ঠিক আছে,তোমার দেখা করতে হবেনা।

টুট,টুট শব্দ হলো।শিখা লাইন কেটে দিয়েছে।খুব রাগ হলো নিজের উপর।কেন বুঝিনা মেয়েটাকে।বার বার একই ভুল কিভাবে করি।শিখা অল্পতেই রেগে যায়।তার সাথে কথা বলার সময় অবশ্যই ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয়।

পরপর তিনবার কল দেওয়ার পর শিখা কল রিসিভ করলো।বলল,কি চাই?বিরক্ত করবানা বলছি,খবরদার।আমি বললাম,স্যরি,স্যরি।আর হবেনা।আমি তো গাধা।কানে ধরলাম।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিখা বলল,প্লিজ ভনিতা করোনা।এখন এসবে আমি আর গলবোনা।কি বলবে বলো।ঘুমাবো।আমি বললাম,কাল দেখা করবো।শিখা বলল,তোমার তো অফিস আছে।তাহলে?আমি বললাম,সব বাদ।কোন অফিস নেই।আমি কালকের জন্য সম্পূর্ণ বেকার।

শিখা বলল,কোথায় দেখা করবে?আমি ভয়ার্ত কন্ঠে শিখাকে বললাম,আমার বাসায় আসো।যা ভয় পাচ্ছিলাম তাই হলো।শিখা গর্জন দিয়ে বলল,জাতীয় ফালতু একটা ছেলে তুই!

আমি পুনরায় সাহস সঞ্চয় করে বললাম,বিশ্বাস করো আমি উল্টা পাল্টা কিছুই করবোনা।তোমার গায়ে এক মুহূর্তের জন্যও হাত দিবোনা।

শিখা বলল,আমি তোমাকে বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস করিনা।তোমার বাসায় না,অন্য কোথাও।আমি বললাম,খোদার কসম উল্টা পাল্টা কিছুই করবোনা।শেষবারের মত বিশ্বাস করো।তোমার বিশ্বাস ভাঙবোনা।শিখা বলল,ঠিক আছে সকাল দশটায় আসবো।যদি কথা না রাখো….

সারারাত আমার আর ঘুম হয়নি।বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমার শিখা আমার সাথে আবার যোগাযোগ করেছে।রাত পেরুলেই তার সাথে দেখা হবে।সারারাত বিছানায় ছটপট করতে করতে কখন সকাল হলো বুঝতেই পারিনি।কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।

কাছের বন্ধু রাসেলকে কল দিয়ে বললাম,দোস্ত ঘটনা একটা ঘটেছে।শিখা যোগাযোগ করেছিল।একটু পর বাসায় আসবে।দেখা করবে।কি করব বুঝতে পারছিনা।রাসেল বলল,তুই কি শিখাকে সারাজীবনের জন্য পেতে চাস?আমি বললাম,হুম।রাসেল বলল,তাহলে আজ তার সাথে মিলন করবি।সে রাজি না হলে জোর করে হলেও করবি।করার আগে বাধা দিলে পরে ঠিক হয়ে যাবে।আমি বললাম,কি বলছিস এসব?সে কিছুতেই রাজি হবেনা।রাসেল বলল,যা বললাম তা না করলে শিখা কখনোই তোর হবেনা।

দশটা বেজে বিশ মিনিট।শিখা আসেনি।খুব টেনশান হচ্ছিলো তাই কল দিলাম।প্রথমবার না ধরায় আরো দুবার কল দিলাম।শিখা রিসিভ করেনি।মনে হলো সে আজ আর আসবেনা।শুধু শুধু অফিস কামাই করলাম।ছুটিও নেওয়া হয়নি তাই বসের বকুনি খেতে হবে।

শিখা কল করেছে।আমি তার নাম্বার দেখার সাথে সাথেই রিসিভ করে ফেললাম।শিখা বলল,কি সমস্যা?বার বার কল দিচ্ছো কিসের জন্য?অভদ্র ছেলে একটা!আমি বললাম,স্যরি আসতে দেরি হচ্ছে তাই…

শিখা বলল,আমি আসবোনা।তুমিই তো কাল বলেছো তোমার অফিস আছে।আমি বললাম,কিন্তু কাল রাতেই তো তার জন্যে স্যরি বলেছি।আর তুমি আসবে বলেছিলে।শিখা বলল,এখন বলছি আর আসবোনা।কোন সমস্যা?আমি বললাম,না।কোন সমস্যা নেই।শিখা বলল,ঠিক আছে,ফোন রাখো।

মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো।সারারাত যাকে দেখার অপেক্ষায় ছটপট করতে করতে কাটালাম সে বলছে এখন আর আসবেনা।ইচ্ছে করছে দেয়ালে নিজেই নিজের মাথাটা ফাটাই।

মিনিট বিশেক পরই কলিংবেলের শব্দ হলো।দরজা খুলেই শিখাকে দেখতে পেলাম।এবারই প্রথম নই।আগেও অনেকবার শিখা এমন করেছে।শিখাকে বাসায় ডুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
দুজনের কেউই কারো সাথে কথা বলছিনা।আমার নিজেরই খুব লজ্জা হচ্ছে।মনে হচ্ছে আজই প্রথম আমাদের দেখা হয়েছে।নিরবতা ভেঙে শিখাই প্রথমে বলল,কেমন আছো?আমি বললাম,ভালো।তুমি?শিখা বলল,আমিও ভালো।

দুজন অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলছি।শিখার আইসক্রিম খুব প্রিয়।তাই তার জন্যে আগেই কোণ আইসক্রিম এনে রেখেছিলাম।শিখাকে বললাম,আইসক্রিম খাবা?শিখা বলল,হুম।

শিখা আইসক্রিম খাচ্ছে।আমি বসে বসে দেখছি।হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে শিখা আমার সামনে আইসক্রিম এনে বলল,খাও!আমি হালকা করে খেলাম।শিখা বলল,কি খাচ্ছো এসব?বেশি করে খাও।শিখা জোর করে আমাকে আইসক্রিম খাওয়ালো।

ঘন্টাখানেক আমরা দুজন দুজনের সাথে অনেক কথা বললাম যা হয়তোবা আগে কখনো বলিনি।কথার কথা আমি শিখাকে জিজ্ঞেস করলাম,আচ্ছা যদি কখনো আমি মারা যায় তুমি কি কাঁদবে?কথাটি শেষ হওয়ার আগেই শিখার দু-চোখ পানিতে টলমল করছিলো।সে কান্না লুঁকোনোর অনেক চেষ্টা করলো।

এক বুক সাহস নিয়ে আমি শিখার পাশে গিয়ে বসলাম।তার চোখের জল মুছে দিলাম।সে কান্না করছে।তার দু-চোখে আলতুভাবে চুমু খেলাম।শিখা আমাকে বাধা দিলোনা।আমি শিখাকে জড়িয়ে ধরলাম।শিখা কান্না করছে।আমি বললাম,কেন এমন হলো?তিনটা মাস আমরা কেন দূরে ছিলাম?শিখা কোন উত্তর দিচ্ছেনা।আমি শিখাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।মিনিট খানেক পর শিখা বললো,ছাড়ো আমাকে।আমার রাসেলের কথা মনে পড়ল।সে বলেছে সারাজীবনের জন্যে শিখাকে পেতে হলে আজ মিলন করতেই হবে।আমি শিখার কথা শোনলাম না।তাকে আরো শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে খাটে শোইয়ে দিলাম।পাগলের মত আদর করতে থাকলাম তার চোখে,মুখে,ঠোঁটে এবং সারা শরীরে।শিখা বার বার চেষ্টা করলো নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে।আমি খুব কঠিন রূপ ধারণ করলাম।এতোটা কঠিনভাবে তাকে আবদ্ধ করেছি যে শিখা শত চেষ্টা করেও নিজেকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারলোনা।শিখা চুপচাপ হার মানলো।

শিখা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার কাপড়চোপড় ঠিক করছে।আমি দূর থেকে দেখছি।মেয়েটাকে আজ অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।একটু আগে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাদের মিলন হয়েছে।নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে।আমি কখনোই শিখার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই করিনি।তখন যে কি হয়েছিলো,আমার।তবে যাই হোক,শিখাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পাবার আশায় এমনটা করেছি।যা করেছি ভালোবেসেই করেছি।

শিখার চোখ,মুখ লাল হয়ে আছে।মনে হচ্ছে এখনই সে কান্না করবে।সে বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারেনা।আমি শিখার মুখোমুখি দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম।কিন্তু শিখা সরে দাঁড়ালো।আমাকে বলল,ইস্পা….আমি এখন যাবো।শিখা আমাকে কখনোই পুরো নামে ডাকতোনা।আদর করে অর্ধেক নামেই ডাকে।আজও ডেকেছে।আমি বললাম,এখনই চলে যাবে?আরেকটু,থাকো।শিখা বলল,না।বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে আম্মু বকবে।শিখা দরজার সামনে গিয়ে থামলো।দরজা খুলছেনা।কি যেন বলবে ভাবছে।কিন্তু বলতে পারছেনা।তার গলা কাঁপছে।আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তার দিকে তাকিয়ে আছি।শিখা আমার দিকে ফিরে তাকালো।চোখে চোখ রাখলো।তার দু-চোখ জলে একাকার হয়ে গেছে।টপটপ করে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে চোখের নোনাজল।শিখার নিরব কান্না দেখে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না।আমিও কাঁদছি।চোখ মুছতে মুছতে শিখা বললো,ইস্পা…কাজটা তুমি মোটেও ভালো করোনি।কাল রাতে তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে এসবের কিছুই তুমি করবেনা।তোমার কাছে আমার দেহটাই সব হয়ে গেল?আজ সম্পর্কটা ঠিক করতেই আমি এসেছিলাম।এই তিনমাস তোমাকে ছাড়া আমি মোটেও ভালো ছিলাম না।তোমাকে শেষবারের মত বিশ্বাস করেছিলাম।তুমি সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারোনি।তোমার জন্যে আমার অন্তরে যেটুকু শেষ অনুভূতি ছিলো তার সবটাই তুমি আজ শেষ করে দিয়েছো।আমি তোমাকে জীবনেও ক্ষমা করতে পারবোনা।কথাগুলো বলেই আমি কিছু বলার পূর্বে শিখা দরজা খুলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।আমি শুধু হতাশ নয়নে তার চলে যাওয়া দেখলাম…..

রাজারকুল,রামু।